রঘুনাথ শিরোমণি








রঘুনাথ শিরোমণি-একজন অসাধারণ বৈদিক নৈয়ায়িক পন্ডিত। তার খ্যাতি ভারত জুড়ে। পাশ্চাত্যের জ্ঞানীজনরাও তার গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করছেন, চিন্তা নিয়ে ভাবছেন। পন্ডিত এই ব্যক্তিত্বের জন্ম সিলেটের পঞ্চখন্ডের (বিয়ানীবাজার) পণ্ডিত পাড়া গ্রামে। তিনি তার মা এর দিকে থেকে শূলপাণির প্রপৌত্র ছিলেন (চতুর্দশ শতাব্দী)। শুলপাণি ছিলেন স্মৃতি শাস্ত্রের উপর একজন সুপরিচিত লেখক। তাকে ভারতীয় দর্শনবিদ্যাতে সর্বাপেক্ষা মৌলিক

দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রঘুনাথ ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌম এর একজন ছাত্র। তিনি পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রের নিকট থেকে নব্য ন্যায় পাঠ পেয়েছিলেন যিনি ছিলেন মিথিলার একজন প্রখ্যাত দার্শনিক। তিনি ন্যায় শাস্ত্রে একটি নতুন দিকের সূচনা করেন যেটি নব্য ন্যায় নামে সুবিদিত। এটি ভারতীয় যুক্তি শাস্ত্রের চূড়ান্ত উন্নয়নকল্পে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থান দখল করে নেয়। তিনি নবদ্বীপকে নব্য ন্যায় অধ্যয়ন করার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । 



তার যখন বয়স ৪/৫ বছর তখন তার বাবা মারা যান। রঘুনাথের বাবা গোবিন্দ চক্রবর্তী এবং মা সীতাদেবী। রঘুনাথের আরেকজন ভাই ছিলেন,তার চেয়ে পনের ষোল বছরের বড়। তার নাম রঘুপতি। রঘুপতিও পন্ডিত ছিলেন। তিনি ইটার(শ্রীহট্ট) রাজা সুবিদ নারায়নের খঞ্জা কন্যা রত্নবতীকে বিয়ে করেন। তার মা এটি চাননি। রঘুপতি মায়ের অমতে বিয়ে করলে মা রাগ করে দেশ ছাড়েন। শিশু রঘুনাথকে নিয়ে নবদ্বীপে চলে যান। নবদ্বীপের খুব নাম ডাক ছিলো ভারতে জ্ঞান চর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবে। জ্ঞানী মানুষের সমাবেশ ছিলো এখানে। রঘুনাথের মা নবদ্বীপে বাসুদেব সার্বভৌম নামের একজন বিখ্যাত পন্ডিতের কাছে আশ্রয় নেন। বাসুদেব ছিলেন বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। মিথিলায় অধ্যয়ন শেষে চুড়ান্ত পরীক্ষায় শীর্ষস্থান লাভ করেন। তিনি ন্যায়-শাস্ত্রে ‘সার্বভৌম’ উপাধিলাভ করে নবদ্বীপে ফিরে আসেন বাসুদেব নবদ্বীপে উচ্চমানের একটি টোল প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্ররা অধ্যয়ন করতো। একদিন সীতাদেবী চুলো জ্বালাবার জন্যে রঘুনাথকে টোলের হোস্টলে পাঠালেন ছাত্র কারো কাছ থেকে আগুনে নিয়ে আসতে। ছাত্ররা তখন টোলে পড়ছিলো। আগুন চাইতেই বিরক্ত হয়ে অথবা দুষ্টুমী করে একজন ছাত্র আগুনের জলনত কয়লা এনে রঘুনাথকে বললো-কয়লা নেবার জন্য হাত পাতো। রঘুনাথ যে কত্তো বুদ্ধি রাখতেন বুঝা যায় এ ঘটনায়। তিনি সাথে সাথে দু’হাতের তালুতে বেশী করে বালি নিয়ে হাত পেতে দিলেন। জ্বলন্ত কয়লা হাতে দিলে তা থাকবে কালির উপরে। কাজেই হাত পুড়ে যাবার কোন ভয় নেই। রঘুনাথ পঞ্চখন্ডে থাকতেই শিবরাম তর্ক সিন্ধান্তের টোলে কিছু পড়ালেখা করেছিলেন। এখানেও তিনি শিক্ষককে নানা প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলে দিতেন। 

নবদ্বীপে তিনি বাসুদের সার্বভৌমের কাছে ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করতে থাকলেন। একসময় আরো বেশী করে পড়াশোনার জন্য রঘুনাথ মিথিলা গেলেন। মিথিলা সে সময় ন্যায়শাস্ত্র চর্চার একটি শ্রেষ্ঠ স্থান। মিথিলায় এমন কিছু গ্রন্থ ছিলো যেগুলা সেখানকার পন্ডিতরা মিথিলার বাইরে নিয়ে যেতে দিতেন না। রঘুনাথের গুরু বাসুদেবও মিথিলায় অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি মিথিলা থেকে সেই সব গ্রন্থ আনতে পারবেন না জেনে গ্রন্থগুলো মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। একইভাবে রঘুনাথও সেই অমূল্য গ্রন্থগুলো মুখস্থ করে নবদ্বীপে ফিরেছিলেন। মিথিলার সে সময়ের ভারতের বিখ্যাত নৈয়ায়িক পন্ডিতগুরু পক্ষধর মিশ্রের কাছে রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পক্ষধর মিশ্র পন্ডিতের টোলে বসার ধরন ছিলো একটু অন্যরকম। সিড়ির মতো বসার আসন। সবচে যে কম জানে সে বসতো সবচে নীচের সিড়িতে এবং সবচে যে বেশী জানতো সে বসতো সিড়ির সবচে উপরের ধাপে গুরুর পাশের আসনে। রঘুনাথ সিড়ির সবচে নীচে বসে অধ্যয়ন শুরু করেন। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি সিড়ির সবচে উপরের ধাপ গুরুর পক্ষধর মিশ্রের পাশে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তর্ক যুদ্ধে হারিয়েও দিয়েছিলেন গুরুকে। গুরুর একটি গ্রন্থের ভুল ধরলে গুরু ক্ষেপে যান। ছেলেবেলায় সামান্য আঘাতে রঘুনাথের একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। গুরু ক্ষেপে গিয়ে রঘুনাথকে ‘এক চোখ কানা’ বলেও কটাক্ষ করেন। অবশ্য রঘুনাথ যুক্তিতর্ক দিয়ে গুরুকে বুঝাতে সক্ষম হন,গুরু ভুল করেছেন।পরে গুরু ভুল বুঝেছিলেন। রঘুনাথকে খেতাব দিয়েছিলেন ‘শিরোমণি’। সেই থেকে রঘুনাথ হলেন ‘রঘুনাথ শিরোমণি’। মিথিলা থেকে রঘুনাথ জ্ঞানের কথা লেখা বইগুলো মুখস্থ করে ফিরে আসলেন নবদ্বীপে। নবদ্বীপে রঘুনাথ শিরোমনি একটি টোল খুললেন। দলে দলে ছাত্ররা ভিড় জমালো তার টোলে। মিথিলা বিজয়ী রঘুনাথ শিরোমণির কারনে নবদ্বীপই হয়ে উঠলো ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের মধ্যে ন্যায়দর্শণ অধ্যয়নের সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থান। রঘুনাথ শিরোমণি নবদ্বীপে প্রবর্তন করলেন ন্যায়-দর্শনের সর্বোচ্চ উপাধি প্রদানের পরীক্ষা গ্রহণ প্রথা। রঘুনাথের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতবর্ষের এমনকি পাশ্চাত্য দেশের ছাত্ররাও ভর্তি হন। রঘুনাথ শিরোমণি ৪১টি বই লিখেছেন। সবগুলো বই এখন পাওয়া যায় না। তবে বেশ কিছু বইয়ের খোজঁ পাওয়া গেছে। কিছু কিছু বই ইংলিশে অনুবাদও হয়েছে।

রঘুনাথ শিরোমণির ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। আসলে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানে এতোই উজ্জ্বল ছিলেন,পন্ডিতজনরা সেই ঔজ্জ্বল্যতায় নিজেদেরকে আলোকিত করেছেন। রঘুনাথ শিরোমণির ব্যক্তিগত জীবন জানতে হয়তো তাই তাদের আগ্রহ ছিলো কম। তবুও যতোটুকু জানা যায় তিনি বিয়ে করেননি। কেউ কেউ মনে করেন তিনি বিয়ে করেছিলেন। রামভদ্র নামে তার একশিষ্য ছিলেন। কেউ কেউ তাকে রঘুনাথ শিরোমণির পুত্র মনে করে থাকেন। আরেকটি বিষয় অনেকে বলে থাকেন বাসুদেব সার্বভৌমের টোলে একসাথে পড়তেন শ্রীচৈতন্যদেব ও রঘুনাথ শিরোমণি। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানেও (১৯৭৬ঃ প৪৪৮) বলা হয়েছে চৈতন্যদেবের সহপাঠী ছিলেন রঘুনাথ। আবার এই চরিতাভিধানেই উল্লেখ করা হয়েছে শ্রীচৈতন্য ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং রঘুনাথ শিরোমণি ১৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নিয়েছেন। এ হিসেবেই ধারণা করা যায় দু’জন সহপাঠী ছিলেন না ‘চৈতন্য রঘুনাথ সহপাঠী ’ মিথটি অস্বীকার করেছেন অমূল্যচন্দ্র সেন, রাজেন্দ্র ঘোষ,এমন কি পরম বৈষ্ণব ফণীভূষণ তর্কবাগীশও। রঘুনাথ শিরোমণি ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপেই পরলোক গমন করেন।তার সম্পর্কের বিশ্লেষণ সংখ্যার সত্যি প্রকৃতি প্রকাশ করেছিল যেটি প্রাকৃতিক প্রত্যক্ষ ঘটনার ধারণা থেকে অবিচ্ছেদ্য। অধিবিদ্যা সম্পর্কে তার অধ্যয়ন একটি জটিল বাস্তবতার নঞর্থকের সঙ্গে জড়ানো ছিল । তার বিখ্যাত গ্রন্থের একটি হচ্ছে তত্ত্বচিন্তামণিদিধীতি। 

রঘুনাথকে কেন্দ্র করে নব্য ন্যায় শাস্ত্রকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়: 

১.    প্রাকশিরোমণি যুগ, 

২.    শিরোমণিযুগ এবং 

৩. শিরোমণি-উত্তর যুগ। 



রঘুনাথের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশ। সেগুলির মধ্যে অনুমানদীধিতি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। এটি প্রায় ৪০০ বছর যাবৎ সমগ্র ভারতে ন্যায় দর্শন চর্চার শাস্ত্র হিসেবে সমাদরের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: প্রত্যক্ষমণিদীধিতি, তত্ত্বচিন্তামণিদীধিতিটীকা, শব্দমণিদীধিতি, আখ্যাতবাদ, নঞ্বাদ, পদার্থখণ্ডন, দ্রব্যকিরণাবলীপ্রকাশদীধিতি, গুণকিরণাবলীদীধিতি, আত্মতত্ত্ববিবেকদীধিতি, ন্যায়লীলাবতী প্রকাশদীধিতি, বাজপেয়বাদ প্রভৃতি। 



তিনি স্মৃতিশাস্ত্রেও দক্ষ ছিলেন। মলিম্লুচবিবেক প্রভৃতি তাঁর স্মৃতিশাস্ত্রের গ্রন্থ। 









তাঁর আবিষ্কারগুলি হল: 



১) ঈশ্বর চিরন্তন আশীর্বাদ ও চেতনার স্থান কিন্তু তা জাগতিক নয় 



২) কাল, শূণ্য, মন এবং আকাশগুলি কোনো পৃথক শয্যা নয়। তিনি অনেকগুলি বস্তুর কথা বলেন যেগুলি বৈষেশিকা'র সাতটি শ্রেণীর মধ্যে নেই। সেগুলি হল-



১) স্বত্ত্ব-অধিকার 



২) শক্তি-প্রভাব ফেলার ক্ষমতা 



৩) কারণত্ব-কারণ 



৪) কার্য্যত্ব-কোন প্রভাবের ধর্ম 



৫) সাংখ্য-সংখ্যা 



৬) বৈশিষ্ট্য-যোগ্য ও যোগ্যতার সম্পর্ক 



৭) বিষায়ত-বিষয় ও বস্তুর সম্পর্ক। তিনি আত্মবোধ ও জীবনের নৈতিক উদ্দেশ্য যে মুক্তি, তার উপর জোর দেন।





ন্যায়শাস্ত্রে ৪৪ প্রকার ন্যায় তথা তর্ক রয়েছে।



১ . অন্ধগোলাঙ্গুল ন্যায় 



২ . অন্ধপঙ্গু ন্যায় 



৩ . অন্ধপরম্পরা ন্যায় 



৪ . অন্ধহস্তী ন্যায় 



৫. অর্ধজরতীয় ন্যায়



৬ . উষ্ট্রকণ্টকভোজন ন্যায় 



৭ . কদম্বগোলক ন্যায় 



৮ . করকঙ্কণ ন্যায় 



৯ . কাকতালীয় ন্যায় 



১০ . কাকাক্ষিগোলক ন্যায় 



১১ . কূর্মাঙ্গ ন্যায় 



১২ . কৈমুতিক ন্যায় 



১৩ . খলেকপোত ন্যায় 



১৪ . গঙ্গাস্রোতোন্যায় 



১৫ . গড্ডলিকাপ্রবাহ ন্যায় 



১৬ . গতানুগতিক ন্যায় 





১৭ . গুড়জিহ্বিকা ন্যায় 





১৮ . গোবলীবর্দ ন্যায় 





১৯ . চালনী ন্যায় 





২০. তৃণারণিমণি ন্যায় 





২১ . দগ্ধপত্র ন্যায় 





২২ . দ-চক্রাদি ন্যায় 





২৩ . দ-াপূপ ন্যায় 





২৪ . দশম ন্যায় 





২৫ . নরাঙ্কিত ন্যায় 





২৬ . নষ্টাশ্বদগ্ধরথ ন্যায় 





২৭ . পঞ্চপ্রক্ষালন ন্যায় 





২৮ . মণিমন্ত্রাদি ন্যায় 





২৯ . মূণ্ডকপ্লুত ন্যায় 





৩০ . রাজপুর প্রবেশ ন্যায় 





৩১ . লাজাবন্ধ ন্যায় 








৩২ . লূতাতন্তু ন্যায় 







৩৩ . বকা-প্রত্যাশা ন্যায় 







৩৪ . বিশেষ্যবিশেষণ ন্যায় 







৩৫ . বীচিতরঙ্গ ন্যায় 







৩৬ . বীজাঙ্কুর ন্যায় 







৩৭ . শঙ্খবেলা ন্যায় 







৩৮ . শতপত্রভেদ ন্যায় 







৩৯ . শৃঙ্গগ্রাহিতা ন্যায় 







৪০ . সন্দংশপ্রাপিত ন্যায় 







৪১ . সর্বাপেক্ষা ন্যায় 







৪২ . সিংহাবলোকন ন্যায় 







৪৩ . সূচীকটাহ ন্যায় 







৪৪ . স্থবিরলগুড় ন্যায়।







 রামনাথ তর্কালঙ্কার এবং বাসুদেব সার্বভৌম কর্তৃক এই ৪৪ প্রকার ন্যায় তথা তর্কের রয়েছে। 



হুসেন শাহের অত্যাচারে বাসুদেব সার্বভোম নবদ্বীপ হতে পলায়ন করে পুরীর রাজা প্রতাপ রুদ্রের রাজসভায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইতোপূর্বে সুশান্ত কর মহাশয়ের সাথে তর্কে তিনি হুসেন শাহের স্তুতি করেছিলেন। অথচ হুসেন শাহ নবদ্বীপের সকল বিদ্যাপীঠ ধ্বংস ও 





পন্ডিতদের হত্যা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

ভাস্কর ভট্টাচার্য্য
ভাস্কর ভট্টাচার্য্য

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহালয়া — আগমনীর সুর

তেলকুপী মন্দির

১৯৫০-এর বরিশাল দাঙ্গা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের সূত্রপাত