মহালয়া — আগমনীর সুর

 "যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী

যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী ।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী ।। "

আজ মহালয়া। দেবী দুর্গার বোধন। দেবীপক্ষের সূচনা।

মহালয়া প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে মায়ের আগমনী বার্তা বয়ে আনে।শিউলি ফুলের গন্ধ সাথে কাশ ফুলের দোলা, শরতের হিমেল হাওয়ায় বাঙালি জীবনে দুর্গোৎসবের বাদ্য ধ্বনি শুরু হয়। ঘরে ঘরে মহালয়ার দিন থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যায়। আর এই উৎসবের সুচনা হয় মহালয়ার পুণ্য ভোরে এক অপার্থিব চিরস্মরণীয় কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। যে কণ্ঠস্বর বহু প্রজন্ম ধরে একই মাত্রায় জনপ্রিয়। যে কণ্ঠস্বর না শুনলে দুর্গোৎসবের সুচনা প্রায় অসম্ভব। যে কণ্ঠস্বর ওতপ্রোতভাবে বাঙালির বার্ষিক উৎসবের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। সেই কণ্ঠস্বর প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে প্রতিটি বাড়িতে আকাশবাণী রেডিও কলকাতার জনপ্রিয়তম ও ভারতের বেতার ইতিহাসে দীর্ঘতমকাল ধরে সম্প্রচারিত একমাত্র স্থায়ী বেতার অনুষ্ঠান " মহিষাসুরমর্দিনী" ।আজ আমার প্রতিবেদন এই অনুষ্ঠান এবং তার শিল্পীবৃন্দর উদ্দেশ্যে।

১৯৩১ সালে অন্নপূর্ণা এবং বাসন্তী পুজোর সন্ধিক্ষনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। নাম দেওয়া হয় "দেবী বসন্তেশ্বরী।" এই অনুষ্ঠানকে বলা যেতে পারে মহিষাসুরমর্দিনীর প্রাকপর্ব। অনুষ্ঠানটির নেতৃত্বে ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বাণীকুমার , বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, হরিশচন্দ্র বালি- প্রমুখরা। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল অনুষ্ঠানটি। বাঙালির মনে এতটাই জায়গা করে নেয় এই অনুষ্ঠান যে উৎসাহিত হয়ে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পরের বছরেই এটি চণ্ডীপাঠ হিসাবে অনুষ্ঠিত হবে।এই অনুষ্ঠানের কিছু পরিমার্জন করে ১৯৩২ সালের দুর্গাষষ্ঠীর দিন অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয় " শারদীয়া বন্দনা" নামে।১৯৩৬ সালে নামকরণ হয় " মহিষাসুর বধ" । পরের বছর পরিমার্জিত প্রচার হয় "মহিষাসুরমর্দিনী " নাম নিয়ে।


পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। আর অনুষ্ঠানের তিন মহারথী হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ( চণ্ডীপাঠ) , বাণীকুমার ( স্তোত্র রচনা) ও পঙ্কজকুমার মল্লিক ( গানের সুর) । তবে, মহিষাসুরমর্দিনী তৈরির পিছনে আরেক জনের গুরুত্বপূর্ণ হাত ছিল। তিনি হলেন পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী। তাঁরই নির্দেশে মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসরণ করে মহিষাসুরমর্দিনী তৈরি হয়।বিগত ৮৮ বছর ধরে সেই অনুষ্ঠান ইতিহাস রচনা করে আসছে।

এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বহু গল্প কাহিনী প্রচলিত আছে। ১৯৬৬ সাল অবধি এটি সরাসরি প্রচারিত হত। কথিত আছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যেক শিল্পীকে স্নান করে পরিষ্কার হয়ে পট্টবস্ত্র পরিধান করে রেডিও ষ্টেশনে উপস্থিত থাকতে হত। নামীদামী জনপ্রিয় শিল্পীরাও সেখানে ছাত্রের ন্যায় ব্যবহার পেতেন। সময় উত্তীর্ণ করে পৌঁছালে বা অনুষ্ঠানে ভুলত্রুটি ঘটলে কড়া শাসন জুটত তাঁদেরও। কিছু কঠোর নিয়মাবলী পালন করতে হত। মহালয়ার আগের দিন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার নির্দেশ ছিল। কোনও প্রকার আমোদ-প্রমোদ অনুষ্ঠান, মদ্যপান, রাত্রি জাগরন বারণ ছিল। শিল্পীদের অধ্যবসায় ও নিয়মনিষ্ঠার উদাহরণ দেওয়া হয় এবিষয়ে - যে কেউ এই নিয়মের বিরুদ্ধাচারন করেননি কোনও দিনও। ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। পরনে নতুন থানের ধুতি। উর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত। বাকিরাও স্নান করে গেরুয়া বসনে স্টুডিয়োতে আসতেন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে সবাইকে বলতেন, "সবাই ধ্যান করে নাও।"

মহালয়া অনুষ্ঠানের আগের থেকে পুরো স্টুডিও ফুল দিয়ে সাজানো হত। ধূপ ধুনোর গন্ধে ছেয়ে যেত চারপাশ। গোটা স্টুডিও পুজো পুজো পরিবেশে পরিণত হত। মহিষাসুরমর্দিনী শুরুর আগে বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। আকাশবাণীর অনেকেই অভিযোগ করেন, কায়স্থ সন্তান হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কীভাবে চণ্ডীপাঠ করবেন? তখন অনুষ্ঠানের সর্বময় কর্তা নৃপেন্দ্র মজুমদার বলেন - উনিই করবেন। বাণীকুমারও ঠিক করে নিয়েছিলেন, যদি বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে না নেওয়া হয়, তাহলে তিনি স্তোত্রই লিখবেন না।

এ বার যন্ত্রী শিল্পীদের কথায় আসা যাক। রাইচাঁদ বড়াল যন্ত্রী শিল্পীদের পরিচালনায় ছিলেন। এই বিষয়ে একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলি। যন্ত্রীশিল্পীদের মধ্যে হিন্দু যেমন ছিলেন, মুসলিমও ছিল। মুসলিমরা আবার উর্দুভাষী। রাইচাঁদ বড়াল তাঁদেরকে ভাল করে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। তাঁদেরকে বলা হল, " যখন সংস্কৃত স্ত্রোত পাঠ হবে, তোমরা ইন্সট্রুমেন্ট সাপোর্ট দেবে। আর যখন বাংলায় স্তোত্রপাঠ হবে বাদ্যযন্ত্র বাজাবে না।" অনুষ্ঠান শুরু হল। সংস্কৃতের পর বাংলায় শুরু হল স্ত্রোত্রপাঠ। নির্দেশ মতো হিন্দুরা বাদ্যযন্ত্র বন্ধ রাখলেও মুসলিম বাদকরা বাজিয়েই চলেছেন। তা দেখে চক্ষু কপালে উঠেছে সবার। হতচকিত সকলে। কিন্তু তাঁদের ওই বাজনায় অদ্ভুত সুরেলা আবহ তৈরি হচ্ছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সেটা বুঝতে পারলেন। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে, গদ্যে ছেড়ে সুরে চণ্ডীপাঠ করতে শুরু করলেন। হিন্দু যন্ত্রীরা অগত্যা সেই রেশে আবার বাজাতে শুরু করল। মুসলিম বাদ্যযন্ত্রীদের না বোঝার ফলে তৈরি হল নতুন সৃষ্টি - সুর করে চণ্ডীপাঠ।

১৯৩১ সাল থেকে একটানা এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয়ে এসেছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রথমবার বাধা আসে। সে সময় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার কারণে কলকাতাবাসীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। ওই ভোরবেলায় কলাকুশলীদের স্টুডিও-তে নিয়ে আসার ঝুঁকি নেয়নি আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। যদি কোনও বিপদ হয়ে যায়! এরপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই অনুষ্ঠান রেকর্ডিং করা হবে। হতেই পারে এমন ঘটনা ফের হতে পারে। বা প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাধা হতে পারে। সেই থেকে রেকর্ডিংয়ের ভাবনা শুরু।১৯৬৬ সাল থেকে সেই রেকর্ড বাজিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়। যা আজও অব্যাহত।

আজকের প্রজন্মও প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে কান পেতে শুনতে থাকে মহিষাসুরমর্দিনী। ঘুম জড়ানো চোখে ভেসে ওঠেন দশভুজা মা দুর্গা । প্রতিক্ষায় দিন গোনা শুরু হয় দেবীর আগমনের।

এই প্রসঙ্গে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত শিল্পীবৃন্দের নাম একটু বলতে চাই -

গান গেয়েছিলেন -

  • বাজলো তোমার আলোর বেণু ― সুপ্রীতি ঘোষ
  • জাগো দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী ―দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়
  • ওগো আমার আগমনী-আলো ― শিপ্রা বসু
  • তব অচিন্ত্য রূপ-চরিত-মহিমা ― মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
  • অখিল-বিমানে তব জয়-গানে ― কৃষ্ণা দাশগুপ্ত
  • জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ― সমবেত কণ্ঠ
  • শুভ্র শঙ্খ-রবে ― শ্যামল মিত্র , অসীমা ভট্টাচার্য, আরতি মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্য
  • নমো চণ্ডী, নমো চণ্ডী ― বিমলভূষণ
  • মাগো তব বিনে সঙ্গীত প্রেম-ললিত ― সুমিত্রা সেন
  • বিমানে বিমানে আলোকের গানে ― গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
  • হে চিন্ময়ী ― তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • অমল-কিরণে ত্রিভুবন-মনোহারিণী ― প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
  • জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ― পঙ্কজ কুমার মল্লিক
  • শান্তি দিলে ভরি ― উৎপলা সেন

যন্ত্রীশিল্পীরা হলেন -

  • সারেঙ্গি - মুন্সি,
  • চেলো - আলি
  • হারমোনিয়াম - খুশি মহম্মদ,
  • বেহালা - তারকনাথ দে,
  • ম্যান্ডোলিন - সুরেন পাল,
  • গিটার - সুজিত নাথ,
  • এসরাজ - দক্ষিণামোহন ঠাকুর,
  • ডবল বাস - শান্তি ঘোষ,
  • বেহালা - অবণী মুখোপাধ্যায়,
  • পিয়ানো - রাইচাঁদ বড়াল।

দেবি ভক্তজনোদ্দাম-দত্তানন্দদয়েঽম্‌বিকে ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।

" শান্তি দিলে ভরি।
দুখরজনী গেল তিমির হরি।
প্রেমমধুর গীতি
বাজুক হৃদে নিতি নিতি মা।
প্রাণে সুধা ঢালো
মরি গো মরি। "

শ্রীশ্রীচণ্ডী, শ্রীশ্রীচণ্ডিকার ধ্যান, অর্গলাস্তোত্র, দেবীসূক্ত – শ্রীশ্রীচণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, মাঘ ১৪০২।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তেলকুপী মন্দির