তেলকুপী মন্দির

তেলকুপী পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার একটি জলমগ্ন প্রত্নস্থল যেটি ১৯৫৭ সালে ওই জেলার পাঞ্চেতের কাছে দামোদর নদীর উপর দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন দ্বারা বাঁধ নির্মাণের দরুণ জলমগ্ন হয়ে যায়। তেলকুপী গ্রামে প্রচুর মন্দির ছিল, যেগুলোর অধিকাংশই ১৯৫৯ সালের মধ্যে জলের তলায় চলে যায়। তেলকুপী পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর থানার অন্তর্গত। বর্তমানে তেলকুপী অঞ্চলটি রঘুনাথপুর থানার লালপুর, গুরুন, তারাপুর, জামডি, পাথরবিড়া, ঘরবিড়া এই সকল গ্রামগুলি নিয়ে সমষ্টিত। ১৯৫৬ পর্যন্ত তেলকুপী বিহারের মানভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে তেলকুপীর অবস্থান পুরুলিয়া শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে।

পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৩°৩৯′৫৮.৯০৩″ উত্তর ৮৬°৩৬′২৩.৬২″ পূর্ব
দেশঃ India
প্রদেশঃ পশ্চিমবঙ্গ
জেলাঃ পুরুলিয়া জেলা
সময় অঞ্চলঃIST (ইউটিসি+৫:৩০)
PIN- ৭২৩১৩৩
টেলিফোন কোড- ৩২৫১

প্রাচীন ইতিহাস

তেলকুপীতে প্রাচীন শিখরবংশের পূর্বতন রাজধানী ‘তৈলকম্পী’ অবস্থিত ছিল। সেই সময় মানভূম জেলা শিখরভুম নামে খ্যাত ছিল। শিখরবংশের অপর প্রাচীন রাজধানী পঞ্চকোটগড় থেকে তৈলকম্পীর দুরত্ব ছিল উত্তর-পশ্চিমে ১০.৫ মাইল। শিখরবংশের রাজাদেরই পাঞ্চেতের রাজবংশ বলে অভিহিত করা হয়। এই বংশের রাজা ছিলেন রুদ্রশিখর যিনি অন্যান্য সামন্তরাজাদের সাথে জোট বেঁধে পালবংশের রাজা রামপালকে তাঁর রাজ্য বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছিলেন। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে পঞ্চকোট রাজবংশমালাতে ১০৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রুদ্রশিখরের আবির্ভাব হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় রামপালের রাজত্বকাল ১০৭০-১১২০ বলে উল্লেখ করেছেন। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ রামচরিতম কাব্যগ্রন্থের এই কয়েকটি লাইনে রুদ্রশিখরের বর্ণনা পাওয়া যায়:-

শিখর ইতি সমর পরিসর বিসর দরিরাজ রাজিগত্ত গধ্বগহন দহন দাবানল: তৈলকম্পীয় কল্পতরু রুদ্রশিখর

রামচরিতম প্রাচীনতম গ্রন্থ যেখানে রুদ্রশিখরের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় এই কয়েক লাইনের অর্থ দাঁড়ায়- “যুদ্ধে যার প্রভাব, নদী-পর্বত ও উপান্তভূমি জুড়ে বিস্তৃত, পর্বত কন্দরের রাজবর্গের যিনি দর্প দহনকারী দাবানলের মতো সেই তৈলকম্পের কল্পতরু রুদ্রশিখর"

অনুমান করা হয় যে তেলকুপীর মন্দিরগুলি পাঞ্চেত ও কাশীপুরের রাজাদের মালিকানায় ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে এটা মনে হয় যে এই মন্দিরগুলি সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী সম্প্রদায় দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে দামোদর নদীর জলবাণিজ্য পথের সন্নিকটে থাকার দরুন একসময় তেলকুপী ওই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছিল।

তেলকুপীর মন্দিরসমূহর বিবরণ

বেগলারের বিবরণ
১৮৭৮ এ প্রকাশিত জে. ডি বেগলারের “Report of A Tour through the Bengal Provinces (Vol VIII)” বইতে সর্বপ্রথম তেলকুপীর মন্দির সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। বেগলারের মতে সেসময় ছোটনাগপুর সার্কেলের ভিতর তেলকুপী ব্যতীত এত স্বল্প পরিসরে এতগুলি উত্কৃষ্ট মানের মন্দির দেখা যায়নি। মন্দিরগুলি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগের মন্দিরগুলি গ্রামের উত্তর দিকে নদীর কাছে অবস্থিত ছিল। দ্বিতীয় ভাগের মন্দিরগুলির অবস্থান ছিল গ্রামের কাছে; কিছুটা পশ্চিম দিকে। তৃতীয় মন্দির সমষ্টিগুলি ছিল দক্ষিন পশ্চিম দিকে– গ্রামের শেষ প্রান্তে। প্রথম সমষ্টিতে তেরোটি মন্দির ছিল। দ্বিতীয় মন্দিরসমূহতে বেগলার ছটি মন্দির ও অনেক মূর্তি দেখেছিলেন, যার মধ্যে উনি চারটি মন্দিরকে উল্লেখযোগ্য মনে করেছিলেন। তৃতীয় মন্দিরশ্রেণীর মধ্যে বেগলার তিনটি মন্দির ও একটি মঠের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন। এই শেষাক্ত মন্দিরশ্রেণীর আশেপাশে উনি অনেক পাথরের ও ইঁটের স্তুপ দেখতে পেয়েছিলেন।

প্রথম মন্দির সমষ্টি
১. এই সমষ্টির প্রথম মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি ছোট কুঠুরি ছিল যার মধ্যে একটি শিবলিঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল। অভ্যন্তরের মেঝে দরজার গোবরাট বা চৌকাঠের দুই ফুট নিচে অবস্থিত ছিল। এই চৌকাঠটিও সমতলভূমির প্রায় দুই ফুট নিচে অবস্থিত ছিল। মন্দিরটি পাথরের তৈরী, কিন্তু এখানে পাথরের স্তরবিন্যাস করতে কোনও পেশনীর ব্যবহার করা হয়নি। বেগলার এই মন্দিরের উপরের ভাগ অনেকটাই অক্ষত দেখতে পেয়েছিলেন।

২. দ্বিতীয় মন্দিরটি পূর্বমুখী। বেগলার এই মন্দিরের প্রবেশপথের উপরে একটি গজলক্ষীর ভাস্কর্য দেখতে পেয়েছিলেন। অভ্যন্তরের মেঝে দরজার চৌকাঠের ছয় ইঞ্চি নিচে অবস্থিত ছিল। এখানে চৌকাঠটি সমতলভূমির প্রায় দেড় ফুট নিচে অবস্থিত ছিল। মন্দিরে অভ্যন্তরে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। বেগলার এই মন্দিরের উপরের ভাগ ভগ্ন অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। এই মন্দিরের পদার্থগত উপাদান ও কারিগরি এই সমষ্টির প্রথম মন্দিরের মতন।

বেগলারের দেখা তেলকুপীর মন্দির
৩. এই মন্দিরটি পূর্বোক্ত দুই নম্বর মন্দিরের মতন, কিন্তু বেগলার এটি অনেক আবর্জনার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। এর দরজার চৌকাঠ আবর্জনার স্তুপের মধ্যে চার ফুট নিচে নিম্মজিত ছিল। মন্দিরের অভ্যন্তরের মেঝে আবর্জনা ও মাটির স্তুপের প্রায় ছয় ফুট নিচে অবস্থিত ছিল। এই পশ্চিমমুখী মন্দিরের মস্তক অবশিষ্ট ছিল না। অন্যান্য মন্দিরের মতন এখানেও একটি শিবলিঙ্গ ছিল।

৪. চতুর্থ মন্দিরটি পূর্বমুখী ছিল। প্রবেশ পথের উপর একটি পদ্মর ভাস্কর্য বেগলারের চোখে পড়েছিল। এর অভ্যন্তরে একটি চতুর্ভুজ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণুমূর্তি অনেকটাই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সেসময় মন্দিরটি বেশ ভগ্নদশায় ছিল। এই মন্দিরের পদার্থগত উপাদান ও কারিগরি অন্য মন্দিরগুলির মতন।

৫. পঞ্চম মন্দিরের অবস্থান চতুর্থ মন্দিরের ঠিক পিছনে ছিল। এই মন্দিরটিও অন্য চারটি মন্দিরের মতন। এটির মস্তক অবশিষ্ট ছিল না।

৬. ষষ্ঠ মন্দিরটি আয়তনে বড় ছিল। এই পুবমুখী মন্দিরটির মহামন্ডপ, অর্ধমন্ডপ, গর্ভগৃহ ও বারান্দা ছিল। গর্ভগৃহ ও তার উঁচু মস্তকটি অক্ষত ছিল, কিন্তু ভিতরের ছাদটি ভেঙ্গে পড়েছিল। বেগলার এখানে অনেকগুলি দরজার কাঠামো দেখেছিলেন। মন্দিরের মিনারের ন্যায় মস্তকটির গায়ে চুন সুরকির প্রলেপ দিয়ে অসামান্য কারুকার্য ছিল। বেগলার মনে করেছিলেন যে পরবর্তীকালে এই মন্দিরে গাত্রে দুবার চুন সুরকির প্রলেপ পড়েছিল।

বেগলারের দেখা তেলকুপীর বৃক্ষ কবলিত মন্দির
৭. সপ্তম মন্দিরটি ছিল উত্তরমুখী। এটি তুলনামূলক ভাবে একটি ছোট মন্দির যার ভিতরে একটিমাত্র কুঠুরি ছিল। এই মন্দিরের প্রবেশ পথের ঠিক উপরে গনেশের মূর্তি ছিল। মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি দ্বিভূজা মূর্তি অবস্থান করছিল। তার দুহাতে দুটি পদ্ম ছিল, যা বেগলারের মতে সূর্যর মূর্তির সঙ্গে তুলনামূলক। মূর্তির মাথায় ফিতা দিয়ে বাঁধা উঁচু উষ্ণীষ ছিল। এর দু পাশে চারটি ছোট মূর্তি ছিল এবং মাথার দুই পাশে উড়ন্ত ভঙ্গিমায় আরও দুটি মূর্তি অবস্থান করছিল। এই মন্দিরের পদার্থগত উপাদান ও কারিগরি এই সমষ্টির প্রথম মন্দিরের মতন।

৮. বেগলারের বর্ণনা অনুযায়ী অষ্টম মন্দিরটি একটি পূর্বমুখী বড় আকারের মন্দির ছিল। এটির ভিতরেও প্রথমতঃ একটিমাত্র কুঠুরি ছিল। বেগলারের মতে মন্দিরের সঙ্গে সংলগ্ন সুবিশাল মহামণ্ডপটি পরে সংযোজন করা হয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে মন্দিরের শিখরের সাথে মহামণ্ডপের শিল্পকলার অনেকটাই পার্থক্য আছে। শিখরের গায়ে খোদিত ভাস্কর্য ছিমছাম ও সুরুচিসম্পন্ন, কিন্তু মহামণ্ডপটি একেবারে সাদামাটা। মহামণ্ডপ ও মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপর গণেশের মূর্তি ছিল। বেগলারের মতে মহামণ্ডপ ও মূল মন্দিরের গঠনশৈলীর মধ্যে সামঞ্জস্য ছিল না। তবে বেগলারের এটাও মনে হয়েছিল যে এই অষ্টম মন্দিরের চেয়ে এই সমষ্টির ষষ্ঠ মন্দিরটির স্থাপত্যগত অসামঞ্জস্য অনেক বেশি ছিল। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম মন্দিরটির পাশ দিয়ে একটি গ্রানাইটের দেওয়াল ছিল। এই দেওয়ালের মধ্যে খিলানযুক্ত একটি প্রবেশপথ ছিল। এটি দেখে বেগলার মনে করেন যে দেওয়ালেটি প্রাক মোগলযুগে তৈরী হয়েছিল। উনি মিলিয়ে দেখেন যে দেওয়ালের পদার্থগত উপাদান ও কারিগরি মহামণ্ডপের সাথে মিলে যাচ্ছে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে মহামণ্ডপ ও দেওয়াল দুই মান সিংহের আমলে তৈরী।

৯. নবম মন্দিরটি উত্তরমুখী একটি ছোট মন্দির ছিল যার প্রবেশপথের উপর একটি পদ্মের ভাস্কর্য খোদিত ছিল। সেটির গর্ভগৃহে একটি চতুর্ভূজ মূর্তি অবস্থিত ছিল। মন্দিরের ছাদ পিরামিডের মত ছিল এবং তাতে বড় বড় খাঁজ কাটা ছিল। বেগালারের মতে এই মন্দিরের ছাদের সাথে কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের ছাদের মিল আছে। এই মন্দিরের ভাস্কর্য বেগলারকে মুগ্ধ করেনি, উনি মনে করেছিলেন যে এগুলো অনেক পরের দিকের ভাস্কর্য। ওনার মতে মন্দিরের দরজাও অনেক পরের সংযোজন, আগে এই মন্দিরের দরজা পশ্চিম দিকে ছিল।

১০. দশম মন্দিরটি একটি উত্তরমুখী সুবিশাল মন্দির ছিল। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহর সংলগ্ন বারান্দা, মন্ডপ ও প্রবেশক কক্ষ ছিল। মূল মণ্ডপের তিনটি প্রবেশদ্বার ছিল। বেগলার উত্তর দিকের দরজা বন্ধ পেয়েছিলেন। প্রবেশদ্বারের উপর পদ্মর ভাস্কর্য ছিল, কিন্তু মন্দিরের ভিতরে শুধুমাত্র শিবলিঙ্গ হয়। বেগলার গর্ভগৃহের স্থাপত্য নিয়ে খুশি হতে পারেননি, প্রকারান্তে সেই স্থাপত্যকে কদাকার বলেছেন। মহামণ্ডপের ছাদ নিচু পিরামিডের ন্যায়। বেগালারের মতে এই মন্দির অন্য মন্দিরগুলির চেয়ে অনেক আধুনিক স্থাপত্য।

১১. একাদশ পূর্বমুখী মন্দিরটির প্রবেশদ্বারে গণেশের ভাস্কর্য খোদিত ছিল। গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ বিহিন একটি অর্ঘ ছিল। সেখানে একটি আদিত্য বা সূর্যের মূর্তি ছিল, যা বেগলারের মতে ওই মন্দিরে আদতে ছিল না। বেগলার এই মন্দিরের চূড়া ভগ্ন পেয়েছিলেন।

১২. দ্বাদশ মন্দিরটি একাদশ মন্দিরটির মতন দেখতে ছিল। এটি পূর্বমুখী ছিল এবং এটিরও প্রবেশদ্বারে গণেশের ভাস্কর্য খোদিত ছিল। গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ ছিল।

১৩. ত্রয়োদশ মন্দিরটি অবিকল একাদশ ও দ্বাদশ মন্দিরের মত দেখতে , তফাৎ শুধু এই যে এটি পশ্চিমমুখী।

দ্বিতীয় মন্দির সমষ্টি

বেগলারের দেখা তেলকুপীর মন্দির সমষ্টির অংশবিশেষ
এই সমষ্টির প্রথম মন্দিরটি বেগলার অনেকটাই অক্ষত অবস্থায় দেখতে পান। সেই সময় এর শিখরের উপর আমলক বর্তমান ছিল। আমলকের উপরে ভাণ্ড আকারের শিখরশীর্ষ বিদ্যমান ছিল। এর প্রবেশ দ্বারে গজলক্ষ্মীর ভাস্কর্য ছিল এবং গর্ভগৃহে একটি সুন্দর মূর্তি ছিল। এই মন্দিরের ডানদিকে প্রায় হাজার ফুট দক্ষিণে আরেকটি মন্দির ছিল যার প্রবেশ দ্বারেও গজলক্ষ্মীর ভাস্কর্য ছিল। সেই মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি চতুর্ভূজ বিষ্ণুমূর্তি ছিল।

দ্বিতীয় মন্দিরের পূর্ব দিকে প্রায় আড়াইশ মিটার দুরত্বে একটি উত্তরমুখী মন্দির অবস্থিত ছিল। এর প্রবেশদ্বারের উপর পদ্ম হস্তে একটি উপবিষ্ট মূর্তি ছিল যার পাশে একটি হাতির মূর্তি শুঁড় তুলে দণ্ডায়মান অবস্থায় স্থাপিত ছিল। মূর্তিটি পুরুষ না স্ত্রী সেটি বেগলার অনুধাবন করতে পারেননি। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি নরসিংহ মূর্তি অধিষ্ঠিত ছিল। এই মন্দিরটির পাশেই একটি ভগ্ন চতুর্ভুজ বিষ্ণুর মন্দির ছিল। তার সামনের অংশ ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু বাকি দিকগুলো অক্ষত ছিল। বাকি দুটি মন্দির ও কিছু মন্দির গ্রামের পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। বেগলার এই দুটি মন্দির সম্পর্ক কোনও বিবরণ দিয়ে যান নি |

তৃতীয় মন্দির সমষ্টি
গ্রামের আরও দক্ষিণ দিকে বেগলার কিছু ছড়ানো ছিটানো মন্দির ও একটি ইঁটের ঢিপি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি প্রথম উল্লেখযোগ্য মন্দিরটি শিবের বা বিষ্ণুর মন্দির বলে অনুমান করেছিলেন। দ্বিতীয়টি তিনি বৌদ্ধ মন্দির বলে ধার্য করেছিলেন। এর ঠিক পাশেই ছিল সেই ইঁটের ঢিপি যা বেগলারের মতে একটি মঠের ধ্বংসাবশেষ। তবে বৌদ্ধ মন্দির নিয়ে বেগলার খুব নিসংশয় ছিলেন না কারন প্রবেশদ্বারের উপর মূর্তিগুলো ক্ষয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি মনে করেছিলেন মন্দিরটি জৈন মন্দিরও হতে পারে। এর কাছাকাছি বেগলার আরেকটি মন্দির দেখতে পেয়েছিলেন। তার কাছে একটি বড় ঢিপি ছিল। বেগলার মনে করেছিলেন যে এই শেষোক্ত মন্দিরটি আরও বড় ছিল। মন্দিরটির প্রবেশদ্বার অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাস্কর্য দিয়ে সজ্জিত ছিল। এই ভাস্কর্যের মধ্যে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার ও কৃষ্ণলীলা উল্লেখযোগ্য।

হান্টারের বিবরণসম্পাদনা
১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হান্টারের "Statistical Account of Bengal (volume=XVII)" এ তেলকুপীর মন্দিরসমূহর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। তাতে হান্টার উল্লেখ করেছেন যে দামোদরের তীরে অবস্থিত তেলকুপীতে আট থেকে নয়টি পাথরের মন্দির রয়েছে। সেখানে স্থানীয় লোকেরা একটি মূর্তির পূজা করেন। স্থানীয় ভাষায় তার নাম বিরূপ। হান্টার স্বচক্ষে মূর্তিটি দেখেননি কিন্তু অনুমান করেছিলেন যে এটি চব্বিশতম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের মূর্তি। দেবলা মিত্রর মতে এই বিরূপের মানে হল ভৈরব, যিনি সেই সময় ওখানকার মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ছিলেন। দেবলা মিত্র এই ভৈরবের মন্দিরকে ভৈরবনাথের মন্দির বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৮ সালে দামোদরের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এখানে নিত্যপূজা হত|

বাংলার পূর্ত বিভাগের তালিকায় পাওয়া বিবরণ
১৮৯৬ সালে অবিভক্ত বাংলার পূর্ত বিভাগের দ্বারা সংকলিত বাংলার প্রাচীন সৌধের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় যা ৩১শে আগস্ট ১৮৯৫ পর্যন্ত সংযোজিত করা ছিল। এখানে তেলকুপীর মন্দিরের শুধুমাত্র বেগলারের বর্ণিত প্রথম মন্দির সমষ্টির ১৩টি মন্দিরের উল্লেখ করা হয়। মন্দিরের গঠনশৈলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয় যে এই স্থাপত্য বড় বড় পাথর নিখুঁত আকারে কেটে সূক্ষ্ম ভাবে জোড়া দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। এখানে কোনও পেষণী বা হামানদিস্তার সাহায্য নেওয়া হয়নি। পাথরগুলি ঠিকমতো স্থাপনা করার পর সেগুলিকে ভাস্কর্যমণ্ডিত করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গার ফাঁকগুলি পাথর দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। যেখানে ফাঁকগুলি একটু বেশি বড় সেখানে স্থাপত্যকলার করবেলিং (corbelling) পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। মন্দিরের গোলাকার গম্বুজগুলি এই পদ্ধতিতেই তৈরী করা হয়েছে। এখানে একটিমাত্র খিলানযুক্ত প্রবেশপথ পাওয়া গিয়েছে যা কিনা মন্দিরগুলি পৃথক করবার জন্য পরবর্তী কালে তৈরী করা হয়েছিল। এই তালিকায় উল্লেখ করা হয় যে মন্দিরগুলি মোগল আমলের পরবর্তী যুগের শুরুর দিকে তৈরী হয়েছিল। এখানে শৈব আর বৈষ্ণব দুই সম্প্রদায়ের মন্দির আছে, কারণ এখনে শিবলিঙ্গ , গনেশের মূর্তি ও বিষ্ণুর বিভিন্ন মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই তালিকায় আরও উল্লেখ করা হয় যে মানভূম জেলাতে তেলকুপীর মত বিস্তীর্ণ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আর কোথাও নেই। পার্শ্ববর্তী দামোদর নদ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এলাকার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে আসছে। একের পর এক মন্দির ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাথরের চাঙ্গর, বিভিন্ন মূর্তির খণ্ড, পাথরের বিভিন্ন কারুকার্য এলোমেলো ভাবে দামোদরের গর্ভে বিলীন হয়ে চলেছে এবং ক্রমাগত ভাবে বালির স্তুপ জমে জমে তাদের শেষ প্রামাণিক সাক্ষ্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

টি. ব্লচের বিবরণ
১৯০৩ সালের গোড়ার দিকে বেঙ্গল সার্কেলের আর্কিওলজিকাল সার্ভেয়ার টি. ব্লচ তেলকুপী পরিদর্শন করেন। তিনি বেগলার বর্ণিত ১৩টি মন্দিরের মধ্যে মাত্র ১০টি কে দেখতে পান। তাঁর বর্ণনা বেশ ভাসা ভাসা ছিল। তিনি দামোদরের তীরে অবস্থিত তেলকুপীর মন্দিরসমূহকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। ব্লচের মতে এখানে একসময় ৪০টি মন্দির ছিল, কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১০টি মন্দির আছে যেগুলো অনেকাংশেই অক্ষত আছে। তিনি এই সমষ্টির বাইরে অবস্থিত মন্দিরগুলি নিয়ে মাথা ঘামাননি। ব্লচ এও বলেছেন এখানে দুটি মন্দির অনেক আধুনিক এবং সেখানে নিত্যপূজা হয়ে থাকে। এই দুটি মন্দিরকে ভৈরবনাথ ও মা কালীর মন্দির বলা হয়ে থাকে। ব্লচ অন্য মন্দিরগুলি অনেক কাল ধরে পরিত্যক্ত ও অবহেলিত অবস্থায় দেখতে পান। তাদের মধ্যে দুটির সামনে হলঘর নির্মিত ছিল ও কিছু সূক্ষ্ম কারুকার্য ছিল। সেসময় এগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় ছিল। ব্লচ বলেছেন যে ছোট মন্দিরগুলোর ভিতরে কেবল একটি কুঠুরী ছিল। তিনি কিছু একশিলা বা মোনোলিথিক মন্দিরও ভগ্ন দশায় দেখতে পান। ব্লচ উল্লেখ করেছেন যে এ সকল মন্দিরে আরাধ্য দেবতা হিসাবে সাধারণতঃ শিবলিঙ্গই থাকে, কিন্তু কিছু মন্দিরে সূর্যমূর্তিও আছে। চৌকাঠে রিলিভো আকারে নবগ্রহর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।

নির্মলকুমার বসুর বিবরণ
নির্মলকুমার বসু ডিসেম্বর ১৯২৯ এর প্রথম সপ্তাহে তেলকুপী পরিদর্শন করেন। তিনিই প্রথম তেলকুপীর মন্দিরের সাথে উড়িষ্যার মন্দিরের স্থাপত্যর তফাৎ ও সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন।[৮]:৮ তিনি প্রবাসী পত্রিকায় (ভাদ্র, ১৩৪০) 'মানভূম জেলার মন্দির' প্রবন্ধে উড়িষ্যার মন্দিরের স্থাপত্যর সাথে তেলকুপীর মন্দিরের তফাৎ বোঝাতে লেখেন—“দামোদরের কূলে তেলকুপী বলে যে স্থানটির উল্লেখ করা হইয়াছে সেখানে দশ-বারটি বেশ পুরাতন মন্দির আছে। এগুলি উড়িষ্যার রেখ জাতীয় দেউল। |ইহাদের বাড় তিন অঙ্গে রচিত, অর্থাৎ তাহাতে কেবল পাভাগ, জাংঘ ও বরণ্ড আছে। সে হিসেবে ইহারা উড়িষ্যার পুরাতন রেখ দেউলের সহিত একগোত্রে পড়ে, কিন্তু ইহাদের গঠন এত হাল্কা ধরণের ও গর্ভের সহিত অনুপাতে ইহাদের উচ্চতা এত বেশি যে উড়িষ্যার বদলে গয়া জেলার কোঞ্চ, দেও প্রভৃতি স্থানের মন্দিরের সঙ্গে এগুলিকে এক গোত্রে ফেলিতে হয়। কিন্তু পরবর্তী মন্দিরগুলির সহিত ইহার তফাৎ হইল অঁলার আকৃতিতে। তেলকুপীর মন্দিরগুলি অঁলা গয়া জেলার মন্দিরের অঁলা অপেক্ষা অনেক চেপটা ও অনেক বড়। তাহাতে তেলকুপীর রেখ দেউলগুলিকে একটি বৈশিষ্ট্য দান করিয়াছে। তেলকুপীর বাড় ও অঁলার সাথে যুক্ত ধ্বজা পুঁতিবার একটি পাথরের খাপেও আমরা উড়িষ্যার সাথে তাহার সম্বন্ধের অভাব দেখি। উড়িষ্যার ত্রি-অঙ্গ-বাড়-যুক্ত-রেখ-দেউলে জাংঘে সচরাচর একটি শিখর বসানো থাকে, কিন্তু তৎপরিবর্তে তেলকুপীর জাংঘে কতকগুলি থামের আকৃতি খোদাই করে দেওয়া হইয়াছে।

নির্মলকুমার তেলকুপীর মন্দিরের সাথে উড়িষ্যার মন্দিরের স্থাপত্যর খুব বেশি সাদৃশ্য পাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও লেখেন— “যাহাই হউক উড়িষ্যার প্রভাব যে তেলকুপীতে একেবারেই পড়ে নাই তাহা বলা চলে না। তেলকুপীতে একটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক রেখ দেউল আছে। তাহার সঙ্গে একটি ভদ্র দেউলও সংযোজিত হইয়াছে কিন্তু এই ভদ্র-দেউলের গঠনে শিল্পীরা এমন দু একটি ভুল করিয়াছেন যাহাতে মনে হয় যে তাহারা ভদ্র দেউল গঠনে আনাড়ি ছিলেন। প্রথমতঃ ভদ্রের পিঢ়াগুলি অসম্ভব রকম বড় করা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ তাহাদের গন্ডির উপর ঘন্টা না বসাইয়া সোজাসুজি একটি রেখ-মস্তক বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। তৃতীয়তঃ রেখ-দেউলটির তলজাংঘে বিরাল ও উপর জাংঘে বন্ধকাম না দিয়া শিল্পীরা তলজাংঘেই দুটিকে গুঁজিয়া দিয়াছেন। সেখানেও আবার বিরাল উপরে ও বন্ধকাম নীচে রাখা হইয়াছে। এগুলি শিল্পাচার বিরুদ্ধ, অতএব উড়িষ্যার শিল্পে অনভিজ্ঞ লোকের তৈয়ারী বলিয়া ধরা যাইতে পারে। অথচ উড়িষ্যার সহিত তেলকুপীর যে সম্বন্ধ ছিল তাহা বিরাল প্রভৃতি মূর্তির অস্তিত্বই প্রমাণ করিয়া দিতেছে।”[১১]:৬১৮

দেবলা মিত্রর বর্ণনাসম্পাদনা
১৯৫৯ সালে যখন দেবলা মিত্র তেলকুপি পরিদর্শন করেন, তখন তিনি বেগলার বর্ণিত প্রথম সমষ্টির ১৩টি মন্দিরের মধ্যে মাত্র পাঁচটিকে দেখতে পান। অনেকেই এই প্রথম সমষ্টিকে ভৈরবথান বলে উল্লেখ করেছেন বলে, দেবলা মিত্র দামোদরের তীরে অবস্থিত এই মন্দিরগুলিকে ভৈরবথানের মন্দির বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে এই মন্দিরগুলির নিচের অংশ সারা বছর জলের তলায় থাকে। একমাত্র জুন মাসেই মন্দিরগুলির পূর্ণ অবয়ব দেখা যায়। দেবলা মিত্রর মতে ভৈরবথানে যে পাঁচটি মন্দির উনি দেখতে পেয়েছিলেন সেগুলি বেগলার বর্ণিত প্রথম সমষ্টির ৬, ৮, ৯, ১০ এবং ১৩ নম্বর মন্দির। দেবলা মিত্রর দ্বিতীয় পরিদর্শনের সময় মাত্র ৯ আর ১০ নম্বর মন্দির অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় ছিল। ৬ নম্বর মন্দিরটি ভিত্তিমূল পর্যন্ত ধসে গিয়েছিল। ৮ নম্বর মন্দিরটিও ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছিল, কিন্তু ৬ নম্বর মন্দিরটির থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় ছিল। ভৈরবথানের মন্দির সমষ্টির বাইরে ১৩ নম্বর মন্দিরের একটি ভগ্নাংশর আশে পাশে দেবলা মিত্র অন্তত ১০টি মন্দিরের ভেঙ্গে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেয়েছিলেন। এগুলি পাথরের স্তুপে পরিণত হয়েছিল।[১২]:১৬ ১৩ নম্বর মন্দিরের অদূরে দেবলা মিত্র একটি ছাদবিহীন স্থাপত্য দেখতে পান। তিনি এটিকে ১৯০১-১৯০২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বলে উল্লেখ করেছেন এবং এও বলেছেন যে এখানে খেলাইচন্ডি দেবী প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। খেলাইচন্ডি মহিষাসুরমর্দিনীর একটি চতুর্ভূজা রূপ।

ভৈরবথানের মন্দিরগুলি ছাড়া দেবলা মিত্র অন্য দুটি সমষ্টির মন্দিরগুলি যে অবস্থায় দেখেছিলেন তার বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে ১৬ নম্বর মন্দিরের ধংসাবসেশের মধ্যে মন্দিরের বেঁকি, আমলা, খাপুরি ও চূড়া অবশিষ্ট ছিল।[১২]:৩১ এই মন্দিরটির নাম গাঁওবেদিয়ার দেউল।[১২]:২৯ এর মূল দরজার কাঠামো বেশ সুসজ্জিত ছিল। দরজার দুটি জ্যাম্বের নীচে ছিল দুটি পুরুষ মূর্তি। জ্যাম্বের পাশের দেওয়ালও যথেস্ট অলংকৃত ছিল। সেখনে গঙ্গার ও নবগৃহের মূর্তি খোদাই করা ছিল। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি ভগ্ন সূর্যমূর্তি ছিল।[১২]:৩১ এরপর দেবলা মিত্র উল্লেখ করেছেন যে ১৭ নম্বর মন্দিরটি, যার স্থানীয় ভাষায় নাম নরসিংহথান, অন্য পুরোনো মন্দিরের মধ্যে তুলানমূলক ভাবে ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু মন্দিরের অবস্থা সার্বিকভাবে ভালো ছিল না| মন্দির গাত্রের অনেক অলংকরণ উধাও হয়ে গেছিল বা ভগ্নদশায় ছিল।[১২]:৩৩ ১৮ নম্বর মন্দিরটি হলো সেই মন্দির যেটিকে বেগলার প্রথমে বুদ্ধ মন্দির বলে উল্লেখ করলেও, মন্দির গাত্রে একটি মূর্তি দেখে সেটিকে জৈন মন্দির হওয়ার সম্ভাবনাও উল্লেখ করেছিলেন। দেবলা মিত্র অবশ্য এই মূর্তিটিকে লকুলিশ বলে চিহ্নিত করেছেন। উনি বলেছেন যে লকুলিশের সাথে বুদ্ধমূর্তির অনেক সাদৃশ্য আছে এবং শিব মন্দিরে এরকম ভাস্কর্য থাকা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। এই মন্দিরের ভিতরে অবস্থিত শিবলিঙ্গ এটিকে শৈবদের মন্দির প্রমাণ করার জোরালো দাবি রাখে। এই মন্দিরের পাশে একটি ইঁটের ঢিপি আছে। বেগলার এই ঢিপিকে বৌদ্ধ মঠের অবশেষ ভেবেছিলেন, কিন্তু দেবলা মিত্রর মতে এটি এই মন্দিরের কোনও আনুসঙ্গিক সংযোজনের ধংসাবশেষ।[১২]:৩৭ তিনি এটাও মনে করেন যে এই ত্রিরথ মন্দিরটি ১৭ নম্বর মন্দিরের নির্মাণের পরে নির্মিত।[১২]:৩৮ এই মন্দিরের পাঁচ ফুট উঁচু দরজার কাঠামোকে তিনি বেশ সুসজ্জিত বলে উল্লেখ করেছেন। দরজার দুটি জ্যাম্বের নিচের কুলুঙ্গিতে দুটি পুরুষ মূর্তি বিদ্যমান ছিল। দেবলা মিত্র বলেছেন এই দুটি মূর্তির মধ্যে একটি সালঙ্কারা পুরুষ যার হাতে একটি দন্ড বিদ্যমান রয়েছে, অন্যটিও অলংকারে ভূষিত, মাথায় জটা মুকুট, মুখশ্রী ভয়ংকর এবং তার বাম হাতে ত্রিশুল।[১২]:৪০ মন্দিরের ভিতরে একটি ক্লোরাইটের শিবলিঙ্গ বিদ্যমান। মন্দিরের ভিতরের জল নিষ্কাশনের নালিতে মকর মুখের ভাস্কর্য ছিল।[১২]:৪১

এই সব মন্দির ও তার ধংসাবশেষ ছাড়া দেবলা মিত্র তেলকুপিতে কয়েকটি স্থানীয় ধর্মীয় স্থানের উল্ল্লেখ করেছেন যেখানে কোনও পুরোনো স্থাপত্যের ধংসাবশেষ থাকার উল্লেখ নেই।[১৩]:৪৬ ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা পুরাতাত্ত্বিক বস্তুদের উল্লেখযোগ্য হল খেলাইচন্ডি দেবীর ঘরের মধ্যে অর্ধেক জলে ডুবে থাকা প্রায় আধ ডজন মূর্তি যার মধ্যে পাল যুগের উমা-মহেশ্বর এবং মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি উল্লেখযোগ্য| দেবলা মিত্র ৯ এবং ১০ নম্বর মন্দিরে বিষ্ণু মূর্তি, অম্বিকা ও অন্ধকাসুর বধ মূর্তি ও দেখেছিলেন। তিনি এ সকল মূর্তিকে নিরাপদ স্থানে সরাবর প্রচেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় নৌকার মাঝিরা আপত্তি করায় তাতে সক্ষম হতে পারেননি|[১৩]:৪৭ এছাড়া তিনি গুরুডি গ্রামে শিবথান নামক একটি ধর্মীয় স্থান থেকে স্থানান্তরিত একটি বিষ্ণুমূর্তি দেখেছিলেন| গুরুডি গ্রামে ১৯ নম্বর মন্দির থেকে আনা পাথর থেকে একটি মন্দির তৈরী করে হয়েছিল| দেবলা মিত্র সেখানেই বিষ্ণুমূর্তিটি দেখেছিলেন।

তেলকুপির মন্দিরের বর্তমান অবস্থাসম্পাদনা
দামোদর নদীর জলের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও, প্রখর গ্রীষ্মে নদীর জল যখন কমে যায় তখন কিছু মন্দিরের উপরিভাগ দেখা যায়। এছাড়া আরও কিছু পুরাকীর্তিও দেখা যায়। সেগুলি হল:—

লালপুর গ্রামের শেষে জল প্রান্তে অবস্থিত একটি দেউল স্থানীয় ভাষায় যার নাম দেলগড়া।
গুরুডি গ্রামের শেষ ডাঙায় অবস্থিত বেগলার দ্বারা নির্দেশিত মন্দির সংখ্যা ১৮।
লালপুর গ্রামের অন্যপ্রান্তে ফেরির সাহায্যে ডুবে যাওয়া ভৈরবথানের মন্দিরগুলির মধ্যে একটি মন্দিরের শিখর অংশ লক্ষ্য করা যায়।
গুরুডি গ্রামের উল্টোদিকে ঘরবিড়া গ্রামে আছে প্রাচীনতম দেউল যার স্থানীয় নাম দেল।
গুরুডি গ্রামের এক শিব মন্দিরে, শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু ও জৈন নেমিনাথের মূর্র্তি ছাড়া কিছু অশনাক্ত আরও বেশ কিছু মূর্তি আছে।
জামাডি গ্রামে ধান চাষের মাঠের আলের উপর উত্থিত কুল গাছের তলায় স্থাপিত হাতির উপর আসীন চতুর্ভুজ মাতৃকা মূর্তি। স্থানীয় মহিলাদের দ্বারা মা লিরলা দেবী নাম পরিচিত।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহালয়া — আগমনীর সুর

The Mysterious History Behind The Precious Tea Garden